আল্লাহর কাছে কি খ্যাতি চাইতে পারি? জানুন ইসলাম কি বলে!
আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই?
আল্লাহর কাছে কি খ্যাতি চাইতে পারি? এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই অনেকের মনে উঁকি দেয়, তাই না? আমরা সবাই জীবনে কিছু না কিছু অর্জন করতে চাই, নাম করতে চাই, বিখ্যাত হতে চাই। কিন্তু ইসলামে খ্যাতি বা নামের ব্যাপারে কী বলা হয়েছে? চলুন, আজ আমরা এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করি।
ইসলামে খ্যাতি চাওয়া দোষের কিছু নয়, তবে এর পেছনের উদ্দেশ্য এবং প্রক্রিয়া অবশ্যই শরীয়তসম্মত হতে হবে। একজন মুমিন হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা, এবং সেই পথে খ্যাতি যদি আসে, তবে তা অবশ্যই গ্রহণীয়।
ইসলামে খ্যাতির ধারণা
ইসলামে খ্যাতির সংজ্ঞা একটু ভিন্ন। এখানে খ্যাতি মানে শুধু মানুষের মাঝে পরিচিত হওয়া নয়, বরং আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়া এবং তাঁর পথে কাজ করে যাওয়া। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, "দুনিয়ার জীবন আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।" তাই, আমাদের প্রতিটি কাজ এমন হওয়া উচিত, যা আখিরাতের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।
খ্যাতি কি সবসময় খারাপ?
মোটেই না! খ্যাতি সবসময় খারাপ নয়। যদি আপনার খ্যাতি মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে, ইসলামের পথে আনে, বা সমাজের উপকার করে, তবে তা অবশ্যই ভালো। উদাহরণস্বরূপ, একজন ভালো ইসলামিক বক্তা বা একজন সমাজসেবক তার কাজের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করলে, তা সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যাটা হলো নিয়তে। যদি খ্যাতির উদ্দেশ্য হয় শুধু নিজের বড়ত্ব জাহির করা, অহংকার করা, বা মানুষকে দেখানোর জন্য ভালো কাজ করা, তবে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, "যারা নিজেদের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না, শয়তান তাদের সঙ্গী হয়, আর শয়তান কতই না নিকৃষ্ট সঙ্গী!" (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৮)
আল্লাহর কাছে খ্যাতি চাওয়ার নিয়ম
আল্লাহর কাছে খ্যাতি চাইতে হলে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। আসুন, সেগুলো জেনে নিই:
১. নিয়তের পরিশুদ্ধতা
প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো নিয়তকে পরিশুদ্ধ করা। আপনার উদ্দেশ্য হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। খ্যাতি যেন আপনার কাজের মূল লক্ষ্য না হয়, বরং আল্লাহর পথে চলার একটি মাধ্যম হয়।
২. ভালো কাজের মাধ্যমে
ইসলামে ভালো কাজ করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আপনি যদি মানুষের উপকার করেন, গরিবদের সাহায্য করেন, জ্ঞান বিতরণ করেন, বা অন্য কোনো ভালো কাজ করেন, তবে আল্লাহ আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং এর মাধ্যমে আপনি খ্যাতিও পেতে পারেন।
৩. দোয়া করা
আল্লাহর কাছে দোয়া করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন যেন তিনি আপনাকে এমন কাজ করার তৌফিক দেন, যা তাঁর কাছে পছন্দনীয় এবং যা মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। মন রক্ষার দোয়া ও আমল করতে পারেন।
৪. আত্ম-অহংকার পরিহার
খ্যাতি পাওয়ার পর অহংকার করা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, সবকিছু আল্লাহর দান। অহংকার মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। সবসময় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং নিজেকে আরও বিনয়ী রাখতে হবে।
৫. সৎ পথে থাকা
খ্যাতি অর্জনের জন্য কোনো প্রকার অসৎ পথ অবলম্বন করা যাবে না। মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, বা অন্য কোনো অন্যায় কাজের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমার উম্মত নয়।"
খ্যাতি চাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু উদাহরণ
ইসলামের ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে যেখানে মানুষ ভালো কাজের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
১. ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন একজন বিখ্যাত ইসলামিক আইনজ্ঞ। তিনি তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের উপকার করেছেন এবং ইসলামের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর খ্যাতি শুধু তাঁর সময়েই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং আজও মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
২. আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)
আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) ছিলেন একজন বিখ্যাত সুফি সাধক। তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর শিক্ষা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
৩. মাদার তেরেসা
যদিও তিনি মুসলিম ছিলেন না, মাদার তেরেসা মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর কাজ মানবতার এক অনন্য উদাহরণ।
আল্লাহর কাছে কি সরাসরি খ্যাতি চাওয়া যায়?
সরাসরি খ্যাতি চাওয়াটা কেমন দেখায়, তাই না? ধরুন, আপনি নামাজ পড়ছেন আর বলছেন, "হে আল্লাহ, আমাকে বিখ্যাত করে দাও!" একটু বেমানান লাগে। এর চেয়ে বরং এভাবে দোয়া করা ভালো যে, "হে আল্লাহ, আমাকে এমন কাজ করার সুযোগ দাও, যা তোমার সন্তুষ্টি বয়ে আনে এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়।"
তাহলে সঠিক দোয়া কোনটি?
সঠিক দোয়া হলো আল্লাহর কাছে তাঁর সন্তুষ্টি এবং ক্ষমা চাওয়া। আপনি যদি আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারেন, তবে খ্যাতি এমনিতেই আপনার পেছনে ঘুরবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার ৫ টি উপায় অবলম্বন করতে পারেন।
খ্যাতি নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
আমাদের চারপাশে খ্যাতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করে। আসুন, কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর জেনে নিই:
১. খ্যাতি কি জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত?
না, খ্যাতি জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। খ্যাতি যদি এর পথে আসে, তবে তা গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে এটিকে জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য বানানো উচিত নয়।
২. খ্যাতির জন্য প্রতিযোগিতা করা কি জায়েজ?
যদি প্রতিযোগিতাটি সৎ পথে হয় এবং এর উদ্দেশ্য হয় ভালো কাজ করা, তবে তা জায়েজ। তবে, যদি প্রতিযোগিতাটি অহংকার, হিংসা, বা বিদ্বেষের জন্ম দেয়, তবে তা অবশ্যই নিন্দনীয়।
৩. খ্যাতি পেলে কী করা উচিত?
খ্যাতি পেলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং নিজেকে আরও বিনয়ী রাখা উচিত। মনে রাখতে হবে, খ্যাতি একটি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে নিজেকে সৎ পথে রাখতে হবে এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে।
৪. খ্যাতির পেছনে না ছুটে কীভাবে আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়া যায়?
খ্যাতির পেছনে না ছুটে আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার অনেক উপায় আছে। কিছু উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো:
- নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত নিয়মিত করা।
- কোরআন তেলাওয়াত করা এবং এর অর্থ বোঝা।
- মানুষের উপকার করা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া।
- সৎ পথে জীবন যাপন করা এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকা।
- আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া।
৫. খ্যাতি এবং সম্মান কি একই জিনিস?
আসলে, খ্যাতি আর সম্মান দেখতে একই রকম হলেও এদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। খ্যাতি অনেকটা বাহ্যিক, যা মানুষ আপনাকে দেয় আপনার কাজের জন্য। অন্যদিকে, সম্মান আসে ভেতর থেকে, যা মানুষ আপনাকে দেয় আপনার চরিত্রের জন্য। খ্যাতির ঝলক ক্ষণস্থায়ী হতে পারে, কিন্তু সম্মান চিরকাল থাকে।
খ্যাতি: ভালো না খারাপ?
আসলে, খ্যাতি নিজে থেকে ভালো বা খারাপ কিছু নয়। এটা নির্ভর করে আপনার ব্যবহারের ওপর। খ্যাতিকে আপনি কিভাবে ব্যবহার করছেন, সেটাই আসল।
নিচের টেবিলটি দেখলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে:
খ্যাতিের ব্যবহার | ফলাফল |
---|---|
ভালো কাজে | আল্লাহর সন্তুষ্টি, মানুষের কল্যাণ |
খারাপ কাজে | আল্লাহর অসন্তুষ্টি, সমাজের ক্ষতি |
অহংকার | ধ্বংস |
বিনয় | উন্নতি |
শেষ কথা
আল্লাহর কাছে খ্যাতি চাওয়া দোষের কিছু নয়, যদি আপনার উদ্দেশ্য সৎ হয় এবং আপনি সৎ পথে থেকে ভালো কাজ করেন। খ্যাতিকে জীবনের মূল লক্ষ্য না বানিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে চলুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।
আশা করি, আজকের আলোচনা আপনাদের ভালো লেগেছে। কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!
আল্লাহ হাফেজ!