ইসলামে গান শোনা কি হারাম? ইসলামিক দৃষ্টিকোণ
ইসলামে গান শোনা কি হারাম? জানুন ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে!
গান! সুরের মূর্ছনায় মনকে রাঙিয়ে তোলার এক অসাধারণ মাধ্যম। কারো মন খারাপ থাকলে গান শুনে ভালো হয়ে যায়, আবার কারো আনন্দ আরও বেড়ে যায় পছন্দের গান শুনলে। কিন্তু ইসলামে গান শোনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে, "ইসলামে গান শোনা কি হারাম?" – এই প্রশ্নটি অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। চলুন, আজ আমরা কোরআন ও হাদিসের আলোকে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি এবং জানার চেষ্টা করি ইসলাম এ বিষয়ে কী বলে।
ইসলামে গান শোনা কি হারাম?
ইসলামে গান শোনা হারাম কিনা, তা নিয়ে ইসলামিক scholars-দের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন গান শোনা সম্পূর্ণরূপে হারাম, আবার কেউ কিছু শর্তের সাথে গান শোনার অনুমতি দেন। এই বিতর্কের মূল কারণ হলো কোরআন ও হাদিসে গানের বিষয়ে সরাসরি কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। তাই বিভিন্ন ইসলামিক পণ্ডিতগণ তাঁদের নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই বিষয়ে মতামত দিয়েছেন।
কোরআনের আলোকে গানের বিধান
কোরআনে সরাসরি গানের কথা উল্লেখ না থাকলেও, কিছু আয়াতে এমন কিছু বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, যা থেকে গানের বৈধতা বা অবৈধতা নিয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
-
সূরা লুকমানের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অসার কথা কেনে"। এখানে "অসার কথা" বলতে গান বাদ্যকেও বোঝানো হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
অন্যদিকে, সূরা ফুরকানের ৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন তারা অনর্থক কথা শোনে, তখন ভদ্রভাবে পাশ কাটিয়ে যায়"। এই আয়াতে অনর্থক কথা থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়েছে, যা সাধারণভাবে অশ্লীল বা খারাপ গান থেকে দূরে থাকার উপদেশ হিসেবে ধরা হয়।
হাদিসের আলোকে গানের বিধান
হাদিসেও গানের বিষয়ে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। কিছু হাদিসে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, আবার কিছু হাদিসে সাধারণভাবে আনন্দ প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
-
সহীহ বুখারীর একটি হাদিসে বলা হয়েছে, "আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমি বস্ত্র, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে"। এই হাদিস থেকে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি নিরুৎসাহিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে, ঈদের দিনে ছোট বালিকাদের গান গাওয়ার অনুমতি এবং বিয়ের অনুষ্ঠানে দফ বাজানোর হাদিসও পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায় কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বৈধ। যেমন, আনন্দের উপলক্ষ্যে বৈধ গান গাওয়া যায়।
গান শোনা নিয়ে ইসলামিক বিশেষজ্ঞদের মতামত
ইসলামিক চিন্তাবিদ ও আলেমগণ গান শোনা নিয়ে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। তাঁদের মতামতগুলো সাধারণত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত:
-
পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা: এই মতের সমর্থকরা বলেন, গান শোনা সম্পূর্ণরূপে হারাম। তাঁদের যুক্তি হলো, গান মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে এবং অশ্লীলতার দিকে ধাবিত করে।
-
শর্তসাপেক্ষে বৈধ: এই মতের আলেমরা কিছু শর্তের সাথে গান শোনার অনুমতি দেন। শর্তগুলো হলো:
- গানের কথা অশ্লীল বা ইসলামবিরোধী হওয়া যাবে না।
- গানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সীমিত হতে হবে।
- গান শোনা যেন নামায বা অন্যান্য ইবাদতের সময় বাধা না দেয়।
- গান শোনা যেন অতিরিক্ত আসক্তির কারণ না হয়।
-
সাধারণ অনুমতি: এই মতের আলেমরা বলেন, সাধারণভাবে গান শোনা বৈধ, যদি তা অশ্লীলতা ও খারাপ উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত হয়। তাঁরা যুক্তি দেন যে, গান মানুষের মনে আনন্দ দেয় এবং ক্লান্তি দূর করে।
কোন ধরনের গান শোনা বৈধ?
ইসলামের দৃষ্টিতে সব গান এক নয়। কিছু গান আছে যা শোনা বৈধ, আবার কিছু গান শোনা হারাম। নিচে বৈধ ও অবৈধ গানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
বৈধ গানের বৈশিষ্ট্য
- গানের কথা ইসলামিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।
- গানে কোনো অশ্লীল বা খারাপ কথা থাকা যাবে না।
- গানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সীমিত ও শালীন হতে হবে।
- গান যেন ইবাদতের পথে বাধা না হয়।
- দেশাত্মবোধক গান, ইসলামী সংগীত (হামদ, নাত) শোনা যেতে পারে।
অবৈধ গানের বৈশিষ্ট্য
- গানের কথা অশ্লীল, অশালীন ও ইসলামবিরোধী হওয়া।
- গানে অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, যা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে।
- গান শোনা যেন নামায ও অন্যান্য ইবাদতের সময় বাধা দেয়।
- গানের মাধ্যমে যেন কোনো খারাপ কাজের প্রতি উৎসাহিত করা না হয়।
ইসলামে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার
ইসলামে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে ইসলামিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বাদ্যযন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে হারাম মনে করেন, আবার কেউ কেউ বিশেষ কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের অনুমতি দেন।
বাদ্যযন্ত্র | মতামত |
---|---|
দফ (এক ধরনের ছোট tambourine) | অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, বিয়ের অনুষ্ঠানে এবং ঈদের দিনে দফ বাজানো বৈধ। |
অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র (যেমন: গিটার, পিয়ানো) | এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন এগুলো সম্পূর্ণরূপে হারাম, আবার কেউ বলেন যদি গান ইসলামিক নীতি মেনে চলে এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সীমিত থাকে, তবে তা বৈধ হতে পারে। |
অনেকে মনে করেন যে বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে কণ্ঠের মাধুর্যে সৃষ্ট গান বেশি গ্রহণযোগ্য।
গান শোনার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়
গান শোনার ক্ষেত্রে আমাদের উচিত ইসলামিক নীতি ও মূল্যবোধ অনুসরণ করা। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন এমন গান না শুনি যা আমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং খারাপ কাজের প্রতি উৎসাহিত করে।
- অশ্লীল ও অশালীন গান পরিহার করুন।
- ইসলামিক সংগীত ও দেশাত্মবোধক গান শুনুন।
- গান শোনার সময় ইবাদতের কথা মনে রাখুন।
- গানকে জীবনের প্রধান অংশে পরিণত করবেন না।
রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমল সম্পর্কে জানতে পারেন।
কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
ইসলামে গান শোনা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেওয়া হলো:
-
ইসলামে কি সব ধরনের গান হারাম?
উত্তর: না, সব ধরনের গান হারাম নয়। যে গান ইসলামিক নীতি ও মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তা শোনা যেতে পারে। -
ইসলামিক গান শোনা কি জায়েজ?
উত্তর: হ্যাঁ, ইসলামিক গান শোনা জায়েজ। ইসলামিক গান মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে এবং ভালো কাজে উৎসাহিত করে। -
মহিলাদের গান গাওয়া কি হারাম?
উত্তর: মহিলাদের গান গাওয়া সাধারণভাবে হারাম নয়, তবে শর্ত হলো তাদের কণ্ঠ যেন পরপুরুষের জন্য ফেতনা সৃষ্টি না করে। -
গান বাজনার ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি কী?
উত্তর: গান বাজনার ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যদি তা অশ্লীলতা ও খারাপ উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত হয়, তবে তা শোনা যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। -
ইসলামে কোন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বৈধ?
উত্তর: দফ নামক বাদ্যযন্ত্রটি কিছু শর্তসাপেক্ষে বৈধ। -
গান শুনলে কি গুনাহ হয়?
উত্তর: যদি গান অশ্লীল, অশালীন বা ইসলামবিরোধী হয়, তবে তা শুনলে গুনাহ হতে পারে। -
গান শোনার ইসলামিক বিধান কী?
উত্তর: গান শোনার ইসলামিক বিধান হলো, গান যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে না নেয় এবং খারাপ কাজের প্রতি উৎসাহিত না করে। -
গান নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের মতামত কী?
উত্তর: গান নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন গান সম্পূর্ণরূপে হারাম, আবার কেউ কিছু শর্তের সাথে গান শোনার অনুমতি দেন। -
ইসলামে বাদ্যযন্ত্রের বিধান কী?
উত্তর: ইসলামে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বাদ্যযন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে হারাম মনে করেন, আবার কেউ কেউ বিশেষ কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের অনুমতি দেন। -
ইসলামে কোন গান শোনা উচিত?
উত্তর: ইসলামী সংগীত, দেশাত্মবোধক গান, এবং যে গানে ভালো উপদেশ রয়েছে, সেই গান শোনা উচিত।
জুমার দিনের আমল সম্পর্কে জানতে পারেন।
উপসংহার
ইসলামে গান শোনা নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও, আমাদের উচিত সবসময় ইসলামিক নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। গান শোনার ক্ষেত্রে আমাদের বিচার-বিবেচনা করতে হবে, কোন গান আমাদের জন্য কল্যাণকর এবং কোন গান ক্ষতিকর। পরিশেষে, আমরা যেন এমন গান শুনি যা আমাদের মনকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর পথে চলতে সাহায্য করে।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি আপনাকে "ইসলামে গান শোনা কি হারাম?" এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। আপনার যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আপনার মতামত আমাদের কাছে মূল্যবান।