ইসলামে ছবি তোলা কি জায়েজ?
আপনি কি জানতে চান ইসলামে ছবি তোলা জায়েজ নাকি নাজায়েজ? এই প্রশ্নটা অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। আসলে, ছবি তোলা নিয়ে ইসলামে বিভিন্ন মতভেদ আছে। কেউ বলেন এটা সম্পূর্ণ হারাম, আবার কেউ কিছু শর্তের সাথে জায়েজ বলেন। আজকের এই ব্লগ পোষ্টে আমরা কুরআন, হাদিস ও ইসলামিক স্কলারদের মতামত অনুযায়ী এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। সেই সাথে, আধুনিক প্রযুক্তি আসার পর ছবি তোলার নিয়ম কানুন কতটা পরিবর্তন হয়েছে, সেটাও দেখব। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
১. ইসলামের মৌলিক নীতি ও ছবি:
ইসলামের কিছু মৌলিক নীতি আছে, যেগুলো আমাদের জীবনযাত্রার সবকিছুকে প্রভাবিত করে। ছবি তোলার বিষয়টিও এই নীতির বাইরে নয়।
১.১ আল্লাহর সৃষ্টির অনুকরণের ধারণা:
ইসলামে মনে করা হয়, আল্লাহ্ তায়ালা সবচেয়ে ভালো সৃষ্টিকর্তা। তাঁর সৃষ্টির মতো করে কিছু বানানো বা আঁকা এক ধরনের ধৃষ্টতা। তাই, প্রাণীর ছবি আঁকা বা মূর্তি তৈরি করা ইসলামে সাধারণত নিষেধ। কারণ, এতে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে মনে করা হয়।
কিছু ইসলামিক পণ্ডিত মনে করেন, ছবি তোলাও একই কারণে নিষেধ। কারণ এখানেও আল্লাহর সৃষ্টির নকল করা হয়। তারা বলেন, মানুষ যখন কোনো প্রাণীর ছবি তোলে, তখন সে আল্লাহর সৃষ্টি করা একটি জিনিসের হুবহু প্রতিচ্ছবি তৈরি করার চেষ্টা করে।
১.২ ফিকহবিদদের মধ্যে মতভেদ:
ছবি তোলা নিয়ে ইসলামিক পণ্ডিতদের মধ্যে দুইটি প্রধান মত রয়েছে:
- নিষিদ্ধের পক্ষে: এই মত অনুযায়ী, কোনো প্রাণীর ছবি তোলা বা আঁকা সম্পূর্ণ হারাম। যারা এই মত পোষণ করেন, তারা বলেন যে, এটা আল্লাহর সৃষ্টির সাথে পাল্লা দেওয়ার শামিল। এছাড়া, তারা হাদিসের কিছু উদ্ধৃতি দেন যেখানে ছবি তৈরি করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
- শর্তসাপেক্ষে অনুমতির পক্ষে: এই মত অনুযায়ী, কিছু ক্ষেত্রে ছবি তোলা জায়েজ। যেমন, যদি ছবি তোলার উদ্দেশ্য হয় কোনো ভালো কাজ, অথবা যদি ছবিতে কোনো জীবন্ত প্রাণী না থাকে (যেমন ল্যান্ডস্কেপ)। এই মতের পণ্ডিতগণ বলেন, সব ছবিই খারাপ নয়। যদি কোনো ছবি ভালো উদ্দেশ্যে তোলা হয়, যেমন শিক্ষা অথবা কোনো স্মৃতি ধরে রাখার জন্য, তাহলে সেটা জায়েজ হতে পারে।
লাজনা আদ-দায়িমার ফাতাওয়া অনুযায়ী প্রাণীর ছবি তোলা বা অঙ্কন করা হারাম। তবে, অনেক আলেম প্রকৃতি বা নিষ্প্রাণ বস্তুর ছবিকে জায়েজ বলেছেন। তাই, এই বিষয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে।
২. প্রযুক্তি ও আধুনিক ফিকহি দৃষ্টিভঙ্গি:
আগেকার দিনে ছবি তোলার পদ্ধতি এখনকার মতো ছিল না। এখন ডিজিটাল ফটোগ্রাফির যুগে সবকিছু অনেক সহজ হয়ে গেছে। তাই, ছবি তোলা নিয়ে ইসলামিক চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও কিছু পরিবর্তন এসেছে।
২.১ ডিজিটাল ফটোগ্রাফির আবির্ভাব:
ডিজিটাল ফটোগ্রাফি আসার পর, ছবি তোলার বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেছে। আগেকার দিনে ছবি ছিল স্থায়ী, কিন্তু এখনকার ডিজিটাল ছবি সহজেই মুছে ফেলা যায় বা পরিবর্তন করা যায়। আগে, ছবি প্রিন্ট করতে হতো এবং সেটা অনেকদিন পর্যন্ত থাকত। কিন্তু এখন, ছবি তোলার পর তা মুহুর্তের মধ্যে ডিলিট করে দেওয়া যায়।
এই কারণে, কিছু ইসলামিক পণ্ডিত মনে করেন যে ডিজিটাল ছবি আগের মতো হারাম নয়, কারণ এটা ক্ষণস্থায়ী। তারা বলেন, যেহেতু এই ছবিগুলো সহজেই মুছে ফেলা যায়, তাই এগুলো মূর্তি বা চিত্রের মতো স্থায়ী নয়।
কিন্তু, অন্য পণ্ডিতরা মনে করেন যে ছবি যেভাবেই তোলা হোক না কেন, এটা যদি কোনো প্রাণীর হয় এবং তা যদি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে তা হারাম। তাদের মতে, ছবি ক্ষণস্থায়ী হোক বা স্থায়ী, এটা আল্লাহর সৃষ্টির নকল করার শামিল।
২.২ উদ্দেশ্যের প্রভাব:
ছবি তোলার উদ্দেশ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি কি কারণে ছবি তুলছেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
যদি কোনো ভালো উদ্দেশ্যে ছবি তোলা হয়, যেমন পরিচয়পত্র তৈরি করা, তাহলে তা জায়েজ হতে পারে। কারণ, এখানে মানুষের প্রয়োজন জড়িত। আইডি কার্ড, পাসপোর্ট অথবা ভিসার জন্য ছবি ব্যবহার করা হয়, যা জীবনের জন্য জরুরি।
কিন্তু, যদি খারাপ উদ্দেশ্যে ছবি তোলা হয়, যেমন অশ্লীল ছবি তোলা বা কাউকে ব্ল্যাকমেইল করা, তাহলে তা অবশ্যই হারাম। ইসলামে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য সমর্থন করা হয় না।
অনেক আলেম বলেছেন, স্মারক বা আইডি কার্ডের মতো প্রয়োজনে ছবি ব্যবহার করা জায়েজ, তবে প্রাণীর পূর্ণাঙ্গ ছবি এড়িয়ে যাওয়া ভালো। এক্ষেত্রে, শুধু প্রয়োজনীয় অংশটুকু ব্যবহার করাই ভালো।
৩. বাস্তব জীবনে ছবি তোলার বিধান:
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছবি তোলার ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা ছবি তুলি। তাই, বাস্তব জীবনে ছবি তোলার বিধান সম্পর্কে জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।
৩.১ মোবাইল ফটোগ্রাফি:
মোবাইল দিয়ে ছবি তোলা এখন খুব সহজ। এই কারণে, এই বিষয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এখন প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন আছে এবং যখন ইচ্ছে ছবি তোলা যায়।
কিছু আলেম মনে করেন, মোবাইলে তোলা ছবি যদি শুধু স্ক্রিনে থাকে এবং প্রিন্ট করা না হয়, তাহলে তা জায়েজ। তারা বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ছবিটা শুধু ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা স্থায়ী রূপ নেয় না।
কিন্তু, যদি সেই ছবি প্রিন্ট করা হয় বা দেয়ালে টাঙানো হয়, তাহলে তা নাজায়েজ। কারণ, তখন এটা স্থায়ী রূপ নেয় এবং মূর্তির মতো হয়ে যায়।
শাইখ আহমাদুল্লাহর ফাতাওয়া অনুযায়ী, ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনে সংরক্ষিত ছবিকে "অস্থায়ী" বিবেচনা করা হয়, তাই এটা জায়েজ হতে পারে। তবে, প্রিন্ট করা বা দেয়ালে টাঙানো উচিত না।
৩.২ ভিডিও চিত্র:
ভিডিও করার বিধানও ছবি তোলার মতোই। যদি ভিডিও কোনো ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়, যেমন শিক্ষামূলক ভিডিও, তাহলে তা জায়েজ। অনেক ইসলামিক স্কলার মনে করেন, ভিডিওর মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ করা একটি ভালো কাজ।
কিন্তু, যদি খারাপ উদ্দেশ্যে ভিডিও করা হয়, যেমন অশ্লীল ভিডিও বা কাউকে হেয় করার জন্য ভিডিও, তাহলে তা হারাম। কারণ, ইসলামে কোনো ধরনের খারাপ কাজকে সমর্থন করা হয় না।
ইসলামিক পণ্ডিতদের মতে, ভিডিও চিত্র সরাসরি ফটোগ্রাফির মতোই, তবে শিক্ষামূলক বা নিরাপত্তা উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অথবা শিক্ষামূলক ডকুমেন্টারি তৈরি করা।
৪. বিতর্কিত বিষয় ও আধুনিক জিজ্ঞাসা:
বর্তমানে এমন কিছু প্রযুক্তি এসেছে, যা নিয়ে ইসলামিক পণ্ডিতদের মধ্যে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) দিয়ে তৈরি ছবি।
৪.১ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) দিয়ে তৈরি ছবি:
বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) দিয়ে খুব সহজেই ছবি তৈরি করা যায়। এই ছবিগুলো দেখতে এতটাই বাস্তব হয় যে, অনেক সময় আসল ছবির সাথে এদের পার্থক্য করা কঠিন।
এই বিষয়ে ইসলামিক পণ্ডিতদের মধ্যে এখনো কোনো স্পষ্ট মতামত নেই। তবে, অনেকে মনে করেন যে AI দিয়ে তৈরি ছবিও এক ধরনের সৃষ্টি, তাই এটা নাজায়েজ হতে পারে। কারণ, এখানে মানুষ প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে নতুন কিছু তৈরি করছে, যা আল্লাহর সৃষ্টির অনুরূপ হতে পারে।
ফিকহি পরিভাষায়, এটিকে "নকল সৃষ্টি" হিসেবে গণ্য করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। ইসলামিক স্কলারদের একটি দল এই বিষয়ে কাজ করছেন এবং খুব শীঘ্রই তারা একটি সুস্পষ্ট মতামত দেবেন বলে আশা করা যায়।
৪.২ চিকিৎসা ক্ষেত্রে ছবি:
চিকিৎসার প্রয়োজনে ছবি তোলা বা স্ক্যান করা জায়েজ। কারণ, এখানে মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন জড়িত। যখন কোনো মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে থাকে, তখন ছবি তোলার চেয়ে জীবন বাঁচানো বেশি জরুরি।
যেমন, এক্স-রে বা আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে শরীরের ভেতরের ছবি তোলা হয়, যা রোগ নির্ণয়ের জন্য খুবই জরুরি। এই ছবিগুলো ছাড়া সঠিক রোগ নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
এই বিষয়ে ইসলামিক পণ্ডিতদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তাঁরা সবাই একমত যে, চিকিৎসা প্রয়োজনে এ ধরনের ছবি জায়েজ। কারণ, মানুষের জীবন রক্ষা করা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
এখানে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ছবি তোলার বিধান আলোচনা করা হলো:
পরিস্থিতির ধরণ | ছবি তোলার বিধান | যুক্তিসঙ্গত কারণ |
---|---|---|
ব্যক্তিগত ছবি (পরিবার ও বন্ধুদের সাথে) | যদি অশ্লীলতা বা অপচয় না থাকে তবে শর্তসাপেক্ষে জায়েজ। | স্মৃতি হিসেবে রাখা অথবা আনন্দ উদযাপন করা। |
শিক্ষামূলক ছবি (বিজ্ঞান, ইতিহাস) | জায়েজ | জ্ঞান অর্জন এবং বিতরণে সহায়তা করা। |
বাণিজ্যিক ছবি (বিজ্ঞাপন, বিপণন) | যদি ইসলামী নীতি অনুসরণ করা হয় তবে শর্তসাপেক্ষে জায়েজ। | হালাল পণ্য ও সেবার প্রচার করা। |
রাজনৈতিক ছবি (সংবাদ, ডকুমেন্টারি) | জনস্বার্থে জায়েজ | সত্য প্রকাশ এবং জনমত গঠন করা। |
চিকিৎসা সংক্রান্ত ছবি (এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি) | জায়েজ | রোগ নির্ণয় এবং জীবন বাঁচানো। |
ইসলামে ছবি তোলার বিধান নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। তাই, আমাদের উচিত এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
উপসংহার
ইসলামে ছবি তোলার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর এবং এর উত্তর দেওয়া সহজ নয়। কুরআন, হাদিস ও ইসলামিক পণ্ডিতদের মতামত অনুযায়ী, কিছু ক্ষেত্রে ছবি তোলা জায়েজ এবং কিছু ক্ষেত্রে নাজায়েজ। তাই, আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
ছবি তোলার সময় আমাদের উদ্দেশ্য এবং context-এর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি কোনো ভালো উদ্দেশ্যে ছবি তোলা হয় এবং তাতে কোনো খারাপ কাজ না থাকে, তাহলে তা জায়েজ হতে পারে।
তবে, যদি ছবি তোলার উদ্দেশ্য খারাপ হয় বা তাতে কোনো অশ্লীলতা থাকে, তাহলে তা অবশ্যই হারাম। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো, কোনো কাজ করার আগে তার ভালো ও খারাপ দিক বিবেচনা করা। ছবি তোলার ক্ষেত্রেও এই নীতি অনুসরণ করা উচিত।
করণীয়:
- ছবি তোলার আগে, নিজের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবুন। আপনি কেন ছবিটি তুলতে চাচ্ছেন, সেটা ভাবুন।
- ইসলামিক পণ্ডিতদের মতামত জানুন এবং সেই অনুযায়ী চলুন। বিভিন্ন আলেমের কাছ থেকে এই বিষয়ে জেনে আপনার সন্দেহ দূর করুন।
- অপ্রয়োজনীয় ছবি তোলা থেকে বিরত থাকুন। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই করুন।
- অন্যের privacy-র প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। কারো অনুমতি ছাড়া ছবি তুলবেন না।
আশা করি, এই ব্লগ পোষ্টটি আপনাকে "ইসলামে ছবি তোলা কি জায়েজ" এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। আপনার যদি আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে আপনি কমেন্ট সেকশনে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আমরা চেষ্টা করব আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে। ধন্যবাদ!