ইসলামে পিতা মাতার অধিকার: জানুন ও মানুন
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার
বাবা-মা! এই দুটো শব্দই যেন একরাশ শান্তি আর ভালোবাসার প্রতীক। আমাদের জীবনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ইসলামেও পিতা মাতার অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কুরআন ও হাদিসে তাঁদের প্রতি সম্মান ও আনুগত্যের নির্দেশও রয়েছে। আসুন, আজ আমরা ইসলামে পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
পিতা মাতার অধিকার: ইসলামের আলোকে
পিতা মাতার অধিকার ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, তাঁদের কথা মান্য করা এবং সাধ্যমতো তাঁদের সেবা করা।
কুরআনের আলোকে পিতা মাতার অধিকার
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন আয়াতে পিতা মাতার প্রতি সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা বনী ইসরাইলের ২৩-২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, "তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; এবং তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলো। এবং তাদের জন্য দয়ার ডানা অবনমিত কর এবং বলঃ হে আমার পালনকর্তা! তাদের প্রতি দয়া কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন।"
এই আয়াত থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, পিতা মাতার প্রতি সম্মান দেখানো এবং তাঁদের সেবা করা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ।
হাদিসের আলোকে পিতা মাতার অধিকার
হাদিসে পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে। একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "পিতা-মাতা জান্নাতের দরজা।" (তিরমিজি)
অন্য একটি হাদিসে তিনি বলেন, "আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত।" (তিরমিজি)
এসব হাদিস থেকে বোঝা যায়, পিতা মাতার সন্তুষ্টি অর্জন করা জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম।
পিতা মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলামে পিতা মাতার প্রতি সন্তানের কিছু বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এগুলো পালন করার মাধ্যমে আমরা তাঁদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করতে পারি।
শারীরিক ও মানসিক সেবা
পিতা-মাতা যখন বৃদ্ধ হন, তখন তাঁদের শারীরিক ও মানসিক সেবা করা সন্তানের অন্যতম দায়িত্ব। তাঁদের খাবার, পোশাক, ওষুধপত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করা উচিত। এছাড়া, তাঁদের সাথে সময় কাটানো, তাঁদের কথা শোনা এবং তাঁদের মানসিক শান্তি নিশ্চিত করাও জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, বয়স্ক বাবা-মায়েরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। এক্ষেত্রে, তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। প্রয়োজনে, আপনারা ইউএসজি অব হোল অ্যাবডোমেন করাতে পারেন, যেন কোনো রোগ বাসা বাঁধতে না পারে।
আর্থিক সহযোগিতা
যদি পিতা-মাতা আর্থিক কষ্টে থাকেন, তবে তাঁদের সাধ্যমতো আর্থিক সাহায্য করা সন্তানের কর্তব্য। তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া এবং তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ সরবরাহ করা উচিত।
কথা ও কাজে সম্মান প্রদর্শন
পিতা-মাতার সাথে সবসময় নম্র ও ভদ্রভাবে কথা বলা উচিত। তাঁদের কোনো কথা বা কাজে অসন্তুষ্ট হলে, সরাসরি তাঁদের সাথে খারাপ ব্যবহার না করে, বুঝিয়ে বলা উচিত। তাঁদের সামনে উঁচু স্বরে কথা বলা বা ধমক দেওয়া উচিত নয়।
দোয়া করা
পিতা-মাতার জন্য সবসময় দোয়া করা সন্তানের অন্যতম কর্তব্য। তাঁদের জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তাঁদের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করা উচিত।
পিতা মাতার অবাধ্য হলে কি হয়?
ইসলামে পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া কবিরা গুনাহ হিসেবে বিবেচিত। এর কারণে দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। পিতা মাতার মনে কষ্ট দিলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এবং জীবনে বরকত কমে যায়।
পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কিত কিছু জরুরি প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার নিয়ে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন থাকে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
বাবা মায়ের ভরণপোষণ করা কি সন্তানের দায়িত্ব?
হ্যাঁ, বাবা মায়ের ভরণপোষণ করা সন্তানের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। যদি বাবা মা নিজেদের ভরণপোষণ করতে অক্ষম হন, তবে সন্তানকে অবশ্যই তাদের দায়িত্ব নিতে হবে।
পিতা-মাতা যদি ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হন, তবে কি তাদের সেবা করা যাবে?
ইসলামে বলা হয়েছে, পিতা-মাতা ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে এবং তাদের সেবা করতে হবে। তবে, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসরণ করতে বাধ্য করা যাবে না।
সন্তান যদি দূরে থাকে, তবে পিতা মাতার অধিকার কিভাবে পূরণ করবে?
সন্তান দূরে থাকলে নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা, তাদের খোঁজখবর নেওয়া এবং সম্ভব হলে মাঝে মাঝে তাদের সাথে দেখা করা উচিত। এছাড়া, তাদের প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য করা এবং তাদের জন্য দোয়া করাও জরুরি।
পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হলে ক্ষমা চাওয়ার নিয়ম কি?
পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হলে দ্রুত তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তাদের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ভবিষ্যতে এমন ভুল না করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে হবে।
মায়ের অধিকার বেশি নাকি বাবার?
ইসলামে মা ও বাবা উভয়েরই সমান অধিকার। তবে, মায়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ, মা গর্ভধারণ, প্রসব এবং লালন-পালনের ক্ষেত্রে অনেক কষ্ট করেন। একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত।"
পিতা মাতার প্রতি আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণা
আমাদের সমাজে পিতা মাতার অধিকার নিয়ে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এগুলো দূর করা জরুরি।
শুধু বৃদ্ধ বয়সে পিতা মাতার খেয়াল রাখা যথেষ্ট
অনেকেই মনে করেন যে, শুধু বৃদ্ধ বয়সে পিতা মাতার খেয়াল রাখলেই যথেষ্ট। কিন্তু ইসলামে বলা হয়েছে, জীবনের প্রতিটি স্তরে পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাঁদের সেবা করা উচিত। শৈশব থেকে শুরু করে শেষ জীবন পর্যন্ত তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা সন্তানের কর্তব্য।
পিতা মাতার ভরণপোষণের দায়িত্ব শুধু ছেলেদের
আমাদের সমাজে অনেকেই মনে করেন যে, পিতা মাতার ভরণপোষণের দায়িত্ব শুধু ছেলেদের। কিন্তু ইসলামে বলা হয়েছে, ছেলে ও মেয়ে উভয়েই তাদের পিতা মাতার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে বাধ্য। যদি ছেলেরা অক্ষম হয়, তবে মেয়েদের এই দায়িত্ব নিতে হবে।
পিতা মাতার কথা সবসময় মানতে হবে
পিতা মাতার কথা মানা অবশ্যই কর্তব্য, তবে যদি তাঁদের কোনো নির্দেশ ইসলাম বিরোধী হয়, তবে তা মানা বাধ্যতামূলক নয়। ইসলামে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সা.) নির্দেশের উপরে কারো নির্দেশ নেই।
পিতা মাতার অধিকার রক্ষায় আমাদের করণীয়
পিতা মাতার অধিকার রক্ষায় আমাদের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে আলোচনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।
- শিক্ষা: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া উচিত। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই তাঁদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারবে।
- সামাজিক উদ্যোগ: সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পিতা মাতার অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসা উচিত। তাঁরা বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে অসহায় পিতা মাতার পাশে দাঁড়াতে পারেন।
পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করতে, আপনারা সন্তান লাভের দোয়া ও আমল সম্পর্কে জানতে পারেন।
পিতা মাতার অধিকার: একটি বাস্তব চিত্র
মনে করুন, জনাব কাশেম সাহেব একজন সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। তিনি তাঁর পিতা মাতার প্রতি সবসময় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী সবকিছু সরবরাহ করতেন। যখন তাঁর বাবা অসুস্থ হলেন, তিনি নিজের ছুটি নিয়ে বাবার সেবা করতেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর মায়ের প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হন। মায়ের একাকিত্ব দূর করার জন্য তিনি প্রায়ই মায়ের সাথে গল্প করতেন এবং তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন।
জনাব কাশেম সাহেবের এই উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, পিতা মাতার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার: কিছু গল্প
ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে সন্তানেরা তাদের পিতা মাতার প্রতি অসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর পিতার প্রতি সম্মান
হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পিতার প্রতি সবসময় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, যদিও তাঁর পিতা ছিলেন একজন মূর্তি পূজারী। তিনি তাঁর পিতাকে নরম ভাষায় ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং তাঁর সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করতেন না।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মায়ের প্রতি ভালোবাসা
হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তাঁর মা যখন জীবিত ছিলেন, তিনি সবসময় তাঁর খেয়াল রাখতেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তিনি সবসময় তাঁর জন্য দোয়া করতেন।
পিতা মাতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পিতা মাতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হওয়া উচিত আরও ব্যাপক ও কার্যকরী।
- আইন প্রণয়ন: পিতা মাতার অধিকার সুরক্ষার জন্য যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা উচিত। এই আইনে তাঁদের ভরণপোষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিধান থাকতে হবে।
- বৃদ্ধাশ্রমের উন্নয়ন: সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমের মান উন্নয়ন করা উচিত। সেখানে যেন তাঁরা সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
- পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা: পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার করা উচিত। এর মাধ্যমে সন্তানেরা তাঁদের পিতা মাতার প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হবেন।
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার: উপসংহার
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শন করা প্রতিটি মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। কুরআন ও হাদিসে তাঁদের প্রতি সদাচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমাদের উচিত তাঁদের শারীরিক ও মানসিক সেবা করা, তাঁদের আর্থিক সহযোগিতা করা এবং তাঁদের জন্য সবসময় দোয়া করা। পিতা মাতার অধিকার রক্ষায় আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, তাহলেই আমরা একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে পারব। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
বর্তমান সময়ে অনেক সন্তানই পিতা-মাতার থেকে দূরে থাকে। এক্ষেত্রে দূরে থেকে ভালোবাসার মানুষকে কাছে আনার উপায়গুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
Recommended Resources
Here are some additional resources that you might find helpful: