ইসলামে বিদআত কি? একটি বিস্তারিত আলোচনা
ইসলামে বিদআত কি: একটি বিস্তারিত আলোচনা
আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন সবাই? আজ আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই আলোচিত হয় – বিদআত। ইসলামে বিদআত কি, কেন এটি পরিত্যাজ্য এবং এর কুফলগুলো কী কী, তা আমরা বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করব। চলুন, শুরু করা যাক!
বিদআত কী?
বিদআত (Bid'ah) একটি আরবি শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ হলো নতুন কিছু উদ্ভাবন করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, বিদআত বলা হয় দ্বীনের মধ্যে এমন কোনো নতুন বিষয় বা প্রথা চালু করা, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর যুগে ছিল না এবং যা দ্বীনের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। সহজ ভাষায়, দ্বীনের নামে নতুন কিছু তৈরি করাই হলো বিদআত।
বিদআতের সংজ্ঞা
ইসলামী পণ্ডিতগণ বিদআতের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। সাধারণভাবে, বিদআত হলো:
- দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করা।
- এমন কোনো ইবাদত বা আমল তৈরি করা, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়।
- দ্বীনের মূল কাঠামো পরিবর্তন করার চেষ্টা করা।
বিদআত কেন পরিত্যাজ্য?
ইসলামে বিদআত সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। এর কারণগুলো হলো:
- আল্লাহর অপছন্দ: আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করা পছন্দ করেন না। কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেন, "আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।" (সূরা আল-মায়েদা: ৩)
- রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিষেধাজ্ঞা: রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদআত সম্পর্কে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, "প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।" (সহীহ মুসলিম)
- দ্বীনের অপূর্ণতা: বিদআতীরা মনে করে যে দ্বীন পরিপূর্ণ নয়, তাই তারা নতুন কিছু সংযোজন করে দ্বীনকে পূর্ণ করতে চায়। অথচ আল্লাহ তায়ালা দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
- উম্মতের বিভেদ: বিদআত সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন বিদআতী আমল নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, যা ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করে।
বিদআতের প্রকারভেদ
বিদআত প্রধানত দুই প্রকার:
- বিদআতে হাসানা (উত্তম বিদআত): কিছু আলেম মনে করেন, কিছু নতুন কাজ যদি শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হয় এবং মানুষের কল্যাণে আসে, তবে তা বিদআতে হাসানা।
- বিদআতে সাইয়্যিয়া (মন্দ বিদআত): যা শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করে, তাই বিদআতে সাইয়্যিয়া।
তবে, অধিকাংশ ইসলামী পণ্ডিতের মতে, বিদআতে হাসানা বলে কিছু নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর স্পষ্ট বাণী "প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা" – এর আলোকে যেকোনো নতুন প্রথা, যা দ্বীনের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়, তা পরিত্যাজ্য।
বিদআতের কুফল
বিদআত সমাজে নানা ধরনের কুফল ডেকে আনে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কুফল হলো:
- দ্বীনের বিকৃতি: বিদআতের মাধ্যমে দ্বীনের মূল শিক্ষা পরিবর্তিত হয়ে যায়। মানুষ সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়।
- ইবাদতের গুরুত্ব হ্রাস: বিদআতী আমলের প্রতি আগ্রহ বাড়লে সুন্নতি ইবাদতের গুরুত্ব কমে যায়।
- কুসংস্কারের বিস্তার: বিদআত কুসংস্কারকে উৎসাহিত করে। মানুষ বিভিন্ন ভিত্তিহীন বিশ্বাস ও প্রথার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
- ঐক্য বিনষ্ট: মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হয়।
বিদআত থেকে বাঁচার উপায়
বিদআত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে:
- কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন: কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
- রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হবে।
- সাহাবায়ে কেরামের পথ অনুসরণ: সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যেভাবে দ্বীন পালন করেছেন, তা অনুসরণ করতে হবে।
- বিদআত সম্পর্কে সচেতনতা: বিদআত সম্পর্কে জানতে হবে এবং তা থেকে দূরে থাকতে হবে।
- আলেমদের পরামর্শ: নির্ভরযোগ্য আলেমদের কাছ থেকে দ্বীনি বিষয়ে পরামর্শ নিতে হবে।
কতিপয় প্রচলিত বিদআত
আমাদের সমাজে অনেক ধরনের বিদআত প্রচলিত আছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিদআত হলো:
- কুলখানি ও চল্লিশা: মৃত্যুর পর কুলখানি ও চল্লিশার অনুষ্ঠান করা।
- মিলাদ ও কিয়াম: মিলাদ মাহফিলে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিনের সম্মানার্থে কিয়াম করা।
- মাজারে সিজদা: মাজারে গিয়ে সিজদা করা এবং সাহায্য চাওয়া।
- শবে বরাত ও শবে কদর: শবে বরাত ও শবে কদরের রাতে বিশেষভাবে ইবাদত করা এবং বিভিন্ন ধরনের হালুয়া-রুটি তৈরি করা।
বিদআত | ইসলামে এর ভিত্তি |
---|---|
কুলখানি ও চল্লিশা | কুরআন ও সুন্নাতে এর কোনো ভিত্তি নেই। |
মিলাদ ও কিয়াম | রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না। |
মাজারে সিজদা | এটি শিরকের অন্তর্ভুক্ত। |
শবে বরাত ও শবে কদরের বিশেষ আমল | কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। |
FAQ: ইসলামে বিদআত নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন
- বিদআত কি গুনাহের কাজ?
অবশ্যই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।" - ছোট বিদআত ও বড় বিদআত এর মাঝে পার্থক্য কি?
কিছু বিদআত আছে যা ছোট গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, আবার কিছু বিদআত আছে যা শিরকের দিকে নিয়ে যায়। তাই উভয়টিই পরিত্যাজ্য। - আমরা কিভাবে বুঝব কোনটি বিদআত?
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যাচাই করতে হবে। যদি কোনো আমল কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত না হয়, তবে তা বিদআত। - বিদআত করলে কি ঈমান নষ্ট হয়ে যায়?
কিছু বিদআত আছে যা ঈমান নষ্ট করে দেয়, যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়া।
উপসংহার
ইসলামে বিদআত একটি মারাত্মক বিষয়। এটি দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি ঘটায় এবং মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই আমাদের উচিত কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান অর্জন করে বিদআত থেকে দূরে থাকা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের দেখানো পথে চলা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন!
যদি এই বিষয়ে আপনার আরো কিছু জানার থাকে, তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। ধন্যবাদ!