ইসলামে সন্তানের অধিকার: বিস্তারিত জানুন
সন্তান আল্লাহর নেয়ামত। এই নেয়ামতের সঠিক কদর করা এবং এর প্রতিপালনে ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামে সন্তানের অধিকার (Islam e sontaner odhikar) সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা প্রত্যেক মুসলিম পিতা-মাতার জন্য আবশ্যক। আসুন, এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ইসলামে সন্তানের অধিকার: একটি বিস্তৃত আলোচনা
সন্তান জন্ম নেওয়ার আগে থেকে শুরু করে সাবালক হওয়া পর্যন্ত তাদের কিছু মৌলিক অধিকার রয়েছে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের সকলেরই এই অধিকারগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।
জন্মগ্রহণের পূর্বে সন্তানের অধিকার
ইসলামে শুধু জন্মের পরেই নয়, বরং গর্ভে আসার পর থেকেই সন্তানের কিছু অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
- ভালো জীবনসঙ্গী নির্বাচন: একজন ভালো জীবনসঙ্গী নির্বাচন করা সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পিতা-মাতার স্বভাব ও আচরণের প্রভাব সন্তানের উপর পরে।
- গর্ভকালীন যত্ন: গর্ভবতী মায়ের সঠিক যত্ন নেওয়া এবং তার প্রয়োজনীয় খাদ্য ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা সন্তানের অধিকারের মধ্যে পরে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সরাসরি সন্তানের উপর প্রভাব ফেলে। এই সময় মায়ের গর্ভকালীন প্রতি মাসের আমল গুলো করা উচিত।
জন্মগ্রহণের পরে সন্তানের অধিকার
জন্মের পরে সন্তানের বেশ কিছু অধিকার রয়েছে, যা পিতা-মাতার অবশ্যই পূরণ করা উচিত।
- সুন্দর নাম রাখা: জন্মের পর সন্তানের সুন্দর ও অর্থবহ নাম রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। নামের ইতিবাচক প্রভাব ব্যক্তির জীবনে পড়ে।
- আকিকা করা: সন্তান জন্মগ্রহণের পর আকিকা করা একটি সুন্নত। এটি সন্তানের কল্যাণ ও সুরক্ষার জন্য করা হয়।
- সঠিক লালন-পালন: সন্তানকে সঠিকভাবে লালন-পালন করা, তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করা পিতা-মাতার দায়িত্ব।
- ইসলামিক শিক্ষা দেওয়া: সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই ইসলামিক শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের মধ্যে দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা জরুরি। তাদের কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য ইসলামিক জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করা উচিত।
- ভালোবাসা ও স্নেহ: সন্তানকে ভালোবাসা ও স্নেহ দেওয়া তাদের মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। তাদের প্রতি সদয় হওয়া এবং তাদের প্রয়োজনগুলো বোঝা উচিত।
- সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা: সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদান করা উচিত। কোনো রোগ হলে দ্রুত রোগ মুক্তির দোয়া পড়া উচিত।
সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে, উভয়ের অধিকার সমান
ইসলামে ছেলে ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। উভয়েরই সমান অধিকার রয়েছে। কন্যা সন্তানকে অবহেলা করা বা তাদের প্রতি বৈষম্য করা ইসলাম সমর্থন করে না। বরং, কন্যা সন্তানের লালন-পালনে বিশেষ ফজিলতের কথা বলা হয়েছে।
পিতার সম্পত্তিতে সন্তানের অধিকার
ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, পিতার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই অধিকার রয়েছে। তবে, এক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন আছে যা মেনে চলতে হয়। সাধারণত, ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি অংশ পায়। কিন্তু, কোনোভাবেই মেয়েদের বঞ্চিত করা যাবে না।
অধিকার | ছেলে | মেয়ে |
---|---|---|
পিতার সম্পত্তিতে অধিকার | হ্যাঁ | হ্যাঁ |
সাধারণত অংশ | বেশি | কম |
কোনোভাবেই বঞ্চিত করা যাবে কি? | না | না |
ভরণপোষণের দায়িত্ব (সাবালক হওয়ার পর) | সাধারণত নিজের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল, তবে পিতা-মাতা অক্ষম হলে দায়িত্ব নিতে হয় | সাধারণত বিয়ের আগ পর্যন্ত পিতার উপর নির্ভরশীল, বিয়ের পর স্বামীর উপর |
সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অনেক অধিকার রয়েছে। তেমনি পিতা-মাতার প্রতিও সন্তানের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
- পিতা-মাতার আনুগত্য: সন্তানকে পিতা-মাতার কথা মান্য করা এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। তবে, ইসলামবিরোধী কোনো কাজে তাদের আনুগত্য করা যাবে না।
- পিতা-মাতার সেবা: বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার সেবা করা সন্তানের অন্যতম দায়িত্ব। তাদের শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনগুলো পূরণ করা উচিত।
- পিতা-মাতার জন্য দোয়া: সন্তানের উচিত সবসময় পিতা-মাতার জন্য দোয়া করা, তাদের ক্ষমা ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।
ইসলামে সন্তানের অধিকার নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
ইসলামে সন্তানের অধিকার নিয়ে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন থাকে। এখানে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
প্রশ্ন ১: ইসলামে কয় বছর বয়স পর্যন্ত সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব পিতার উপর বর্তায়?
ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, সন্তান সাবালক হওয়া পর্যন্ত সাধারণত পিতার উপর লালন-পালনের দায়িত্ব বর্তায়। তবে, ছেলে সন্তান সাবালক হওয়ার পর নিজের উপার্জনে সক্ষম হলে এই দায়িত্ব কিছুটা কমে যায়। অন্যদিকে, কন্যা সন্তান বিয়ের আগ পর্যন্ত পিতার তত্ত্বাবধানে থাকে।
প্রশ্ন ২: যদি কোনো পিতা তার সন্তানকে অস্বীকার করে, তবে সন্তানের অধিকার কি হবে?
যদি কোনো পিতা তার সন্তানকে অস্বীকার করে, তবে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী সন্তানের বংশ পরিচয় ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আদালতের মাধ্যমে পিতৃত্ব প্রমাণ করার সুযোগ রয়েছে। পিতৃত্ব প্রমাণিত হলে সন্তান তার পিতার সম্পত্তি ও অন্যান্য অধিকার পাবে।
প্রশ্ন ৩: ইসলামে এতিম সন্তানের অধিকার কিভাবে সংরক্ষিত হয়?
ইসলামে এতিম সন্তানের অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের লালন-পালন, শিক্ষা ও সুরক্ষার দায়িত্ব সমাজের উপর ন্যস্ত। এতিমখানা ও অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়।
প্রশ্ন ৪: অসচ্ছল পিতা তার সন্তানের ভরণপোষণ করতে অক্ষম হলে কি হবে?
যদি কোনো পিতা অসচ্ছল হন এবং তার সন্তানের ভরণপোষণ করতে অক্ষম হন, তবে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী পরিবারের অন্যান্য সদস্য, যেমন দাদা-দাদী বা নিকটাত্মীয়দের উপর এই দায়িত্ব বর্তায়। এছাড়া, যাকাত ও সাদকার মাধ্যমেও তাদের সাহায্য করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৫: ইসলামে দত্তক নেওয়ার বিধান কি? দত্তক নেওয়া সন্তানের অধিকার কি?
ইসলামে দত্তক নেওয়ার বিধান রয়েছে, তবে এক্ষেত্রে কিছু বিশেষ নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয়। দত্তক নেওয়া সন্তানকে পালক পিতার ঔরসজাত সন্তান হিসেবে গণ্য করা হয় না। তবে, পালক পিতা তার সম্পত্তি থেকে কিছু অংশ ওই সন্তানের জন্য ওসিয়ত করে যেতে পারেন।
সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- শিশুদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করুন।
- তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিন।
- তাদের ভালো কাজে উৎসাহিত করুন এবং ভুল হলে বুঝিয়ে বলুন।
- তাদের জন্য সময় বের করুন এবং একসাথে কিছু শিক্ষণীয় কাজ করুন।
- নিয়মিত তাদের ইসলামিক গল্প ও নবীদের জীবনী শোনান।
- পরিবারের সকলে মিলে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার অভ্যাস করুন।
উপসংহার
ইসলামে সন্তানের অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত তাদের সন্তানদের এই অধিকারগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং তা যথাযথভাবে পালন করা। একটি সুন্দর ও ইসলামিক সমাজ গঠনে এটি অপরিহার্য। আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আজই পদক্ষেপ নিন। এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে, আমাদের জানাতে পারেন।