পাইলস কেন হয়? জানুন কারণ ও মুক্তির সহজ উপায়!
পাইলস কেন হয়? কারণ, লক্ষণ ও ঘরোয়া সমাধান
আচ্ছা, ভাবুন তো, আপনি সুন্দর একটা মুভি দেখছেন আর ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হল, "ইশ! একটু যদি আরাম করে বসতে পারতাম!" পাইলসের সমস্যা থাকলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা পাইলস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে আপনি এর কারণ, লক্ষণ এবং ঘরোয়া সমাধান সম্পর্কে জানতে পারেন।
পাইলস (Piles) বা অর্শ রোগ একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি মলদ্বারের আশেপাশে ফোলা শিরাগুলির কারণে হয়ে থাকে। এই ফোলাগুলি ভেতরে বা বাইরে হতে পারে এবং এর ফলে ব্যথা, অস্বস্তি ও রক্তপাত হতে পারে। তাই, "পাইলস কেন হয়" – এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন জেনে নেই পাইলস আসলে কী।
পাইলস কী?
পাইলস হলো মলদ্বারের ভেতরের বা বাইরের অংশে হওয়া ফোলা। আমাদের মলদ্বারে কিছু রক্তনালী থাকে, যেগুলি কোনো কারণে ফুলে গেলে পাইলসের সৃষ্টি হয়। এটা অনেকটা পায়ের ভেরিকোস ভেইনের মতো।
পাইলস কেন হয়?
পাইলস হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, তার মধ্যে কিছু প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation): দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য পাইলসের অন্যতম প্রধান কারণ। যখন আপনি মলত্যাগ করতে অতিরিক্ত চাপ দেন, তখন মলদ্বারের শিরাগুলোর ওপর চাপ পড়ে এবং সেগুলি ফুলে যায়।
২. গর্ভাবস্থা (Pregnancy): গর্ভাবস্থায় জরায়ু বড় হওয়ার কারণে মলদ্বারের শিরাগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। হরমোনের পরিবর্তনও শিরাগুলোকে দুর্বল করে দিতে পারে।
৩. অতিরিক্ত ওজন (Obesity): অতিরিক্ত ওজন শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে মলদ্বারের শিরাগুলোতে চাপ সৃষ্টি করে, যা পাইলসের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. বংশগত কারণ (Heredity): যদি আপনার পরিবারের কারো আগে থেকে পাইলসের সমস্যা থাকে, তাহলে আপনারও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৫. দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা (Prolonged Sitting): একটানা দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকলে মলদ্বারের শিরাগুলোতে চাপ পড়ে, যা পাইলসের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন, তাদের এই ঝুঁকি বেশি।
৬. কম ফাইবারযুক্ত খাবার (Low-Fiber Diet): খাবারে পর্যাপ্ত ফাইবার না থাকলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, যা পাইলসের ঝুঁকি বাড়ায়।
৭. অতিরিক্ত চাপ (Straining During Bowel Movements): মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ দিলে মলদ্বারের শিরাগুলো ফুলে যেতে পারে।
পাইলসের লক্ষণগুলো কী কী?
পাইলসের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার এই সমস্যা আছে কিনা। নিচে কয়েকটি লক্ষণ উল্লেখ করা হলো:
- মলদ্বারে ব্যথা এবং অস্বস্তি: এটি পাইলসের একটি অন্যতম লক্ষণ। বসার সময় বা মলত্যাগের সময় ব্যথা হতে পারে।
- মলত্যাগের সময় রক্তপাত: অনেক সময় মলের সাথে রক্ত যেতে পারে, যা সাধারণত উজ্জ্বল লাল রঙের হয়।
- মলদ্বারের আশেপাশে ফোলা: মলদ্বারের চারপাশে ফোলা বা মাংসপিণ্ড অনুভব করা যায়।
- চুলকানি: মলদ্বারের আশেপাশে চুলকানি হতে পারে।
- মলদ্বারে ভেজা ভেজা ভাব: সব সময় একটা ভেজা ভেজা অনুভূতি থাকতে পারে।
পাইলস কত প্রকার?
পাইলস প্রধানত দুই প্রকার:
১. অভ্যন্তরীণ পাইলস (Internal Piles): এই ধরনের পাইলস মলদ্বারের ভেতরে হয় এবং সাধারণত দেখা যায় না।
২. বাহ্যিক পাইলস (External Piles): এই পাইলস মলদ্বারের বাইরে হয় এবং এটি দৃশ্যমান।
অভ্যন্তরীণ পাইলস
অভ্যন্তরীণ পাইলস সাধারণত মলদ্বারের ভেতরে হয়ে থাকে, তাই এটি সহজে চোখে পড়ে না। এই ধরনের পাইলসের কিছু লক্ষণ হলো:
- মলত্যাগের সময় রক্তপাত
- মলদ্বারে অস্বস্তি
- কখনও কখনও মলদ্বারের বাইরে ঝুলে আসা (প্রোল্যাপ্স)
অভ্যন্তরীণ পাইলসের পর্যায়
অভ্যন্তরীণ পাইলসকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়:
- প্রথম পর্যায়: এই পর্যায়ে পাইলস মলদ্বারের ভেতরে থাকে এবং শুধু রক্তপাত হয়।
- দ্বিতীয় পর্যায়: মলত্যাগের সময় পাইলস বাইরে আসে এবং আপনাআপনি ভেতরে চলে যায়।
- তৃতীয় পর্যায়: মলত্যাগের সময় পাইলস বাইরে আসে এবং হাত দিয়ে ভেতরে ঢোকাতে হয়।
- চতুর্থ পর্যায়: পাইলস সবসময় বাইরে ঝুলে থাকে এবং ভেতরে ঢোকানো যায় না।
বাহ্যিক পাইলস
বাহ্যিক পাইলস মলদ্বারের বাইরে হয়ে থাকে এবং এটি দৃশ্যমান। এই ধরনের পাইলসের কিছু লক্ষণ হলো:
- মলদ্বারে ব্যথা ও চুলকানি
- মলদ্বারের চারপাশে ফোলা
- রক্ত জমাট বেঁধে থ্রম্বোসড পাইলস তৈরি হতে পারে, যা তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে
পাইলসের ঘরোয়া সমাধান
পাইলসের প্রাথমিক পর্যায়ে ঘরোয়া কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে আরাম পাওয়া যেতে পারে। নিচে কয়েকটি ঘরোয়া সমাধান উল্লেখ করা হলো:
১. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ: আপনার খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে ফল, সবজি, এবং শস্য যোগ করুন। ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে এবং মল নরম করে, যা মলত্যাগ করা সহজ করে তোলে।
২. পর্যাপ্ত পানি পান করা: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা জরুরি। এটি আপনার শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
৩. সিটজ বাথ: সিটজ বাথ হলো উষ্ণ পানিতে কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে বসা। এটি মলদ্বারের ফোলা এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। দিনে কয়েকবার ১০-১৫ মিনিটের জন্য সিটজ বাথ নিতে পারেন।
৪. অ্যালোভেরা জেল: অ্যালোভেরা জেলে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান থাকে, যা পাইলসের কারণে হওয়া ফোলা এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
৫. টিস্যু পেপার ব্যবহার না করা: মলত্যাগের পর নরম কাপড় বা ভেজা টিস্যু ব্যবহার করুন। টিস্যু পেপার ব্যবহার করলে জ্বালাতন হতে পারে।
৬. বরফ ব্যবহার: ব্যথার উপশমের জন্য আক্রান্ত স্থানে বরফ লাগাতে পারেন। এটি ফোলা এবং ব্যথা কমাতে সহায়ক।
পাইলস প্রতিরোধের উপায়
পাইলস প্রতিরোধের জন্য কিছু সহজ উপায় অনুসরণ করতে পারেন:
- নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন কিছু সময় ব্যায়াম করলে হজম ভালো হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: অতিরিক্ত ওজন কমানো এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা পাইলস প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- দীর্ঘক্ষণ বসে না থাকা: একটানা বসে না থেকে মাঝে মাঝে বিরতি নিন এবং হাঁটাহাঁটি করুন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে?
যদিও পাইলসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো ঘরোয়া উপায়ে নিরাময় করা সম্ভব, তবে কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
- অতিরিক্ত রক্তপাত হলে
- তীব্র ব্যথা হলে
- ঘরোয়া উপায়ে কোনো উন্নতি না হলে
- অন্য কোনো জটিলতা দেখা দিলে
পাইলস নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ):
এখানে পাইলস নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনার অনেক কাজে লাগবে:
প্রশ্ন ১: পাইলস কি ছোঁয়াচে?
উত্তর: না, পাইলস ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি সাধারণত জীবনযাপন পদ্ধতি এবং শারীরিক অবস্থার কারণে হয়ে থাকে।
প্রশ্ন ২: পাইলস কি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়?
উত্তর: পাইলস সরাসরি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় না, তবে মলের সঙ্গে রক্ত গেলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ এটি অন্য কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণও হতে পারে।
প্রশ্ন ৩: গর্ভাবস্থায় পাইলস হলে কী করা উচিত?
উত্তর: গর্ভাবস্থায় পাইলস হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঘরোয়া চিকিৎসা এবং ওষুধ ব্যবহার করা উচিত।
প্রশ্ন ৪: পাইলসের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায় কী?
উত্তর: সিটজ বাথ, অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার এবং বরফ প্রয়োগের মাধ্যমে পাইলসের ব্যথা কমানো যায়।
প্রশ্ন ৫: পাইলস থেকে মুক্তি পেতে কতদিন লাগে?
উত্তর: পাইলসের তীব্রতা এবং চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে এটি কতদিনে সারবে। সাধারণত ঘরোয়া চিকিৎসায় কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে, তবে জটিল ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হয়।
পাইলসের আধুনিক চিকিৎসা
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে পাইলসের বিভিন্ন উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
১. রাবার ব্যান্ড লিগেশন (Rubber Band Ligation): এটি একটি সাধারণ পদ্ধতি, যেখানে পাইলসের গোড়ায় রাবার ব্যান্ড পরানো হয়। এর ফলে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং পাইলস ধীরে ধীরে শুকিয়ে পড়ে যায়।
২. স্ক্লেরোথেরাপি (Sclerotherapy): এই পদ্ধতিতে পাইলসে একটি বিশেষ দ্রবণ ইনজেক্ট করা হয়, যা শিরার দেয়াল সংকুচিত করে এবং পাইলসকে সঙ্কুচিত করে তোলে।
৩. ইনফ্রারেড কোয়াগুলেশন (Infrared Coagulation): এই পদ্ধতিতে ইনফ্রারেড আলো ব্যবহার করে পাইলসের টিস্যুগুলো ধ্বংস করা হয়।
৪. সার্জারি (Surgery): জটিল এবং গুরুতর ক্ষেত্রে সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারির মাধ্যমে পাইলস সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করা হয়।
পাইলসের খাবার তালিকা
পাইলসের সমস্যা কমাতে সঠিক খাবার নির্বাচন করা খুবই জরুরি। নিচে একটি খাবার তালিকা দেওয়া হলো, যা পাইলসের রোগীদের জন্য উপকারী:
১. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার:
- সবুজ শাকসবজি: পালং শাক, লাউ শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি।
- ফল: আপেল, কলা, পেয়ারা, কমলা, পেঁপে ইত্যাদি।
- শস্য: লাল চাল, আটা, ওটস ইত্যাদি।
- ডাল: মটর ডাল, মুগ ডাল, মসুর ডাল ইত্যাদি।
২. প্রোবায়োটিক খাবার: দই এবং অন্যান্য প্রোবায়োটিক খাবার হজমক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়।
৩. পর্যাপ্ত পানি: প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা জরুরি।
যে খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত:
- তৈলাক্ত খাবার: ফাস্ট ফুড এবং ভাজা খাবার হজম করা কঠিন এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়াতে পারে।
- মসলাযুক্ত খাবার: অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার মলদ্বারে জ্বালাতন সৃষ্টি করতে পারে।
- ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল: এগুলো শরীরকে ডিহাইড্রেট করতে পারে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়াতে পারে।
পাইলস এবং জীবনযাত্রা
পাইলস শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি আপনার জীবনযাত্রার মানকেও প্রভাবিত করতে পারে। তাই, কিছু বিষয়ে ശ്രദ്ധ দেওয়া জরুরি:
- সময়মতো খাবার গ্রহণ: সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করলে হজম ভালো হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করা যায়।
- মানসিক চাপ কমানো: মানসিক চাপ হজমক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে, তাই যোগা ও মেডিটেশনের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো উচিত।
- ধূমপান পরিহার: ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি পাইলসের সমস্যা বাড়াতে পারে।
পাইলস একটি অস্বস্তিকর সমস্যা হলেও সঠিক পরিচর্যা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যদি আপনি পাইলসের কোনো লক্ষণ অনুভব করেন, তবে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করুন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!
উপসংহার
পাইলস একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এর সঠিক কারণ ও লক্ষণগুলো জানা থাকলে আপনি সহজেই এর থেকে মুক্তি পেতে পারেন। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে পাইলস প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি আপনি মনে করেন আপনার পাইলসের সমস্যা আছে, তাহলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে আপনি সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবেন।
যদি আপনার এই ব্লগ পোস্টটি ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত কমেন্ট করে জানান। আপনার যে কোনো প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ধন্যবাদ!