রক্তে ইনফেকশন কেন হয়? জানুন ভয়ংকর বিপদ ও বাঁচার উপায়!
রক্তে ইনফেকশন কেন হয়? জানুন বিস্তারিত!
আচ্ছা, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে? দুর্বল লাগছে? হয়তো ভাবছেন সামান্য জ্বর, কিন্তু যদি দেখেন এই দুর্বলতা বাড়ছে, তাহলে কিন্তু একটু সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ, রক্তে ইনফেকশন (Blood infection) হওয়াটা কিন্তু মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করব রক্তে ইনফেকশন কেন হয়, এর লক্ষণগুলো কী কী, এবং এর থেকে বাঁচার উপায় কী।
রক্তে ইনফেকশন কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যখন শরীরের কোনো অংশের ইনফেকশন রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে, তখন তাকে রক্তে ইনফেকশন বলে। ডাক্তারি ভাষায় একে সেপ্টিসেমিয়া (Septicemia) বা ব্লাড পয়জনিংও (Blood poisoning) বলা হয়। এটি একটি মারাত্মক অবস্থা, যা দ্রুত চিকিৎসা না করালে জীবনহানির কারণও হতে পারে।
রক্তে ইনফেকশন কেন হয়?
রক্তে ইনফেকশন হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। চলুন, কয়েকটি প্রধান কারণ জেনে নেওয়া যাক:
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ
ব্যাকটেরিয়া (bacteria) হল রক্তে ইনফেকশনের প্রধান কারণ। আমাদের শরীরে সবসময় কিছু ভালো ও খারাপ ব্যাকটেরিয়া থাকে। কিন্তু যখন খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন তারা রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে এবং ইনফেকশন ঘটায়।
ভাইরাস সংক্রমণ
ভাইরাসও (virus) রক্তে ইনফেকশন করতে পারে, যদিও ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে এর ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম। ডেঙ্গু, চিকেন পক্সের মতো ভাইরাস সংক্রমণ রক্তে ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে।
ফাংগাল সংক্রমণ
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে ফাংগাসও (fungus) রক্তে ইনফেকশন ঘটাতে পারে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি।
অন্যান্য সংক্রমণ
এছাড়াও, নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, কিডনি ইনফেকশন, বা পেটের কোনো সার্জারির কারণেও রক্তে ইনফেকশন হতে পারে।
রক্তে ইনফেকশনের লক্ষণগুলো কী কী?
রক্তে ইনফেকশনের কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে, যা দেখে আপনি প্রাথমিক ধারণা পেতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, এই লক্ষণগুলো দেখা দিলেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
জ্বর বা কাঁপুনি
জ্বর আসা বা শীত শীত লাগা রক্তে ইনফেকশনের একটি অন্যতম লক্ষণ। শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে (101°F বা তার বেশি)। আবার অনেক সময় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে।
দুর্বলতা ও ক্লান্তি
অতিরিক্ত দুর্বল লাগা, কোনো কাজে এনার্জি না পাওয়া, এবং সবসময় ক্লান্ত বোধ করা রক্তে ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে।
দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস
শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত শ্বাস নেওয়া একটি গুরুতর লক্ষণ। যদি মনে হয় আপনি পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাচ্ছেন না, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যান।
হার্টবিট বেড়ে যাওয়া
হার্টবিট (heartbeat) বেড়ে যাওয়া বা পালস রেট (pulse rate) দ্রুত হওয়া রক্তে ইনফেকশনের একটি লক্ষণ। সাধারণত, মিনিটে ১০০-এর বেশি বিট হওয়াটা চিন্তার কারণ।
মানসিক বিভ্রান্তি
মাথা ঘোরা, স্মৃতিভ্রম, অথবা অন্য কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দিলে সতর্ক থাকুন। এটি মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবের কারণে হতে পারে।
কম প্রস্রাব হওয়া
প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়া রক্তে ইনফেকশনের কারণে হতে পারে।
ত্বকের পরিবর্তন
ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, র্যাশ (rash) ওঠা, অথবা চামড়ায় ছোপ ছোপ দাগ দেখা দেওয়া রক্তে ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে।
রক্তে ইনফেকশন হলে কী কী জটিলতা হতে পারে?
যদি রক্তে ইনফেকশন দ্রুত শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করা না যায়, তাহলে এটি মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। নিচে কয়েকটি জটিলতা উল্লেখ করা হলো:
সেপটিক শক
এটি রক্তে ইনফেকশনের সবচেয়ে মারাত্মক পর্যায়। সেপটিক শক (septic shock) হলে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়, যা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে অকার্যকর করে দিতে পারে।
অর্গান ফেইলিউর
রক্তে ইনফেকশন শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার, ফুসফুস এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বন্ধ করে দিতে পারে।
টিস্যু ড্যামেজ
রক্তে ইনফেকশনের কারণে শরীরের টিস্যু (tissue) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার ফলে গ্যাংগ্রিন (gangrene) হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
মৃত্যু
সময় মতো চিকিৎসা না করালে রক্তে ইনফেকশন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
রক্তে ইনফেকশন থেকে বাঁচার উপায় কী?
কিছু সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করে রক্তে ইনফেকশনের ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টিপস দেওয়া হলো:
নিয়মিত হাত ধোয়া
নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া জীবাণু দূর করার সবচেয়ে সহজ উপায়। বিশেষ করে খাবার আগে ও টয়লেট ব্যবহারের পরে অবশ্যই হাত ধুতে হবে।
কাটা-ছেঁড়া পরিষ্কার রাখা
শরীরে কোনো কাটা-ছেঁড়া থাকলে তা ভালোভাবে পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ছোটখাটো আঘাতকেও অবহেলা করা উচিত নয়।
টিকা নেওয়া
কিছু রোগের টিকা (vaccine) রক্তে ইনফেকশনের ঝুঁকি কমাতে পারে। তাই সময় মতো প্রয়োজনীয় টিকাগুলো নেওয়া উচিত।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
ডাক্তারের পরামর্শ
শরীরে কোনো ধরনের ইনফেকশন হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
রক্তে ইনফেকশন হলে কি কি টেস্ট করতে হয়?
রক্তে ইনফেকশন সন্দেহ হলে ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন। এই পরীক্ষাগুলো রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কয়েকটি প্রধান টেস্টের নাম দেওয়া হলো:
রক্ত পরীক্ষা (Blood Test)
- কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC): এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের বিভিন্ন কোষের সংখ্যা জানা যায়, যা ইনফেকশন শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
- ব্লাড কালচার (Blood Culture): এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়।
- সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিন (CRP): শরীরে প্রদাহের মাত্রা জানার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
- প্রোক্যালসিটোনিন (PCT): এটি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন শনাক্ত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কার।
ইউরিন টেস্ট (Urine Test)
- মূত্রনালীর সংক্রমণ (urinary tract infection) বা কিডনির সমস্যা থেকে রক্তে ইনফেকশন হয়েছে কিনা, তা জানার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
ইমেজিং টেস্ট (Imaging Test)
- এক্স-রে (X-ray): ফুসফুসে সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া (pneumonia) হয়েছে কিনা, তা দেখার জন্য বুকের এক্স-রে করা হয়।
- সিটি স্ক্যান (CT Scan): পেটের ভিতরে কোনো সংক্রমণ বা ফোড়া (abscess) হয়েছে কিনা, তা জানার জন্য সিটি স্ক্যান করা হয়।
- এমআরআই (MRI): হাড়ের সংক্রমণ (bone infection) বা অন্য কোনো জটিল সমস্যা জানার জন্য এমআরআই করা হয়।
রক্তে ইনফেকশন হলে ঘরোয়া উপায় কি আছে?
যদিও রক্তে ইনফেকশন একটি গুরুতর অবস্থা এবং এর জন্য ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসা জরুরি, কিছু ঘরোয়া উপায় আছে যা আপনি রোগ প্রতিরোধের জন্য অনুসরণ করতে পারেন:
ভিটামিন সি যুক্ত খাবার
ভিটামিন সি (vitamin C) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাই আমলকি, লেবু, পেয়ারা, কমলালেবুর মতো ভিটামিন সি যুক্ত খাবার বেশি করে খান।
হলুদ
হলুদে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি (anti-inflammatory) উপাদান থাকে যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস গরম দুধে হলুদ মিশিয়ে পান করতে পারেন।
রসুন
রসুনে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল (antibacterial) এবং অ্যান্টিভাইরাল (antiviral) উপাদান থাকে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক কোয়া রসুন খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
আদা
আদা হজমক্ষমতা বাড়াতে এবং শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। আদা চা বা আদা মেশানো গরম পানি পান করতে পারেন।
তুলসী
তুলসীর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল (antifungal) বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিদিন কয়েকটি তুলসী পাতা চিবিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম
পর্যাপ্ত বিশ্রাম শরীরকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
প্রচুর পানি পান করা
প্রচুর পানি পান করলে শরীর থেকে টক্সিন (toxin) বের হয়ে যায় এবং শরীর সতেজ থাকে। প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
রক্তে ইনফেকশন নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ):
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা রক্তে ইনফেকশন সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে:
রক্তে ইনফেকশন কি ছোঁয়াচে?
না, রক্তে ইনফেকশন ছোঁয়াচে নয়। এটি সাধারণত শরীরের নিজস্ব ইনফেকশনের কারণে হয়, যা রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়।
রক্তে ইনফেকশন কত দিনে ভালো হয়?
রক্তে ইনফেকশন কত দিনে ভালো হবে, তা নির্ভর করে ইনফেকশনের তীব্রতা এবং চিকিৎসার ওপর। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে উন্নতি আশা করা যায়।
কোন বয়সের মানুষ রক্তে ইনফেকশনে বেশি আক্রান্ত হয়?
শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তারা রক্তে ইনফেকশনে বেশি আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিস থাকলে কি রক্তে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে?
হ্যাঁ, ডায়াবেটিস (diabetes) থাকলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, তাই রক্তে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।
গর্ভাবস্থায় রক্তে ইনফেকশন হলে কী হতে পারে?
গর্ভাবস্থায় রক্তে ইনফেকশন হলে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই মারাত্মক ঝুঁকি হতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রক্তে ইনফেকশন প্রতিরোধের জন্য কি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যায়?
অ্যান্টিবায়োটিক (antibiotic) শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের জন্য ব্যবহার করা হয়। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত নয়।
শেষ কথা
রক্তে ইনফেকশন একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, তাই এর লক্ষণগুলো জানা এবং সময় মতো ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি। সামান্য অসতর্কতাও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!
যদি আপনার উপরে দেওয়া লক্ষণগুলোর মধ্যে কিছু দেখা যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার স্বাস্থ্য আপনার হাতে!