ইসলামে পিতা মাতার অধিকার: জানুন ও মানুন
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার
বাবা-মা! এই দুটি শব্দই যেন ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। আমাদের জীবনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। ইসলামে পিতা মাতার অধিকার (Islam e pita matar odhikar) সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত সেই অধিকারগুলো সম্পর্কে জানা এবং তা যথাযথভাবে পালন করা।
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার কতটুকু, তাঁদের সাথে কেমন আচরণ করা উচিত, এবং তাঁদের অবাধ্য হলে কি হতে পারে – এই সবকিছু নিয়েই আজকের আলোচনা। চলুন, জেনে নেওয়া যাক ইসলামে পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত।
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার ও গুরুত্ব
পিতা-মাতা আমাদের জীবনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। তাঁদের মাধ্যমেই আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে এসেছি। ইসলামে পিতা মাতার অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন ও হাদিসে তাঁদের প্রতি সম্মান ও আনুগত্যের কথা বারবার বলা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, "তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। আর পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো।" (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬)
পিতা-মাতা শুধু আমাদের জন্ম দেন না, তাঁরা আমাদের লালন-পালন করেন, শিক্ষা দেন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করেন। তাঁদের ত্যাগ ও কষ্টের প্রতিদান দেওয়া আমাদের সাধ্যের বাইরে। তাই ইসলামে তাঁদের অধিকারকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
পিতা মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব
পিতা মাতার প্রতি সন্তানের কিছু আবশ্যিক দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্বগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:
- সম্মান ও শ্রদ্ধা: পিতা-মাতার সাথে সবসময় সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে কথা বলা উচিত। তাঁদের কোনো কথাতে অসন্তুষ্ট হওয়া বা তাঁদের সাথে উঁচু স্বরে কথা বলা উচিত নয়।
- আনুগত্য: ভালো কাজে পিতা-মাতার আনুগত্য করা সন্তানের কর্তব্য। তবে, যদি তাঁরা কোনো শরীয়ত বিরোধী কাজ করতে বলেন, তবে তা মানা যাবে না।
- সেবা ও যত্ন: বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার সেবা ও যত্ন করা সন্তানের দায়িত্ব। তাঁদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখা এবং তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করা উচিত।
- আর্থিক সহায়তা: যদি পিতা-মাতা অভাবী হন, তবে তাঁদের আর্থিক সহায়তা করা সন্তানের কর্তব্য। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া উচিত।
- দোয়া: পিতা-মাতার জন্য সবসময় দোয়া করা উচিত। তাঁদের জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত কামনা করা উচিত।
পিতা মাতার অবাধ্য হওয়ার কুফল
ইসলামে পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া কবিরা গুনাহ হিসেবে বিবেচিত। এর কারণে দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়।
- আল্লাহর অসন্তুষ্টি: পিতা-মাতার অবাধ্য হলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। এর ফলে জীবনে বরকত কমে যায় এবং নানা ধরনের বিপদাপদ নেমে আসে।
- দুনিয়াতে লাঞ্ছনা: পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান সমাজে লাঞ্ছিত হয় এবং মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়।
- আখিরাতে শাস্তি: পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়ার কারণে আখিরাতে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
পিতা-মাতার মনে কষ্ট দেওয়া বা তাঁদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা কোনোভাবেই উচিত নয়। তাঁদের দোয়া সন্তানের জন্য আল্লাহর রহমতস্বরূপ।
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
প্রশ্ন ১: ইসলামে পিতার অধিকার বেশি নাকি মাতার?
ইসলামে পিতা ও মাতা উভয়েরই সমান অধিকার রয়েছে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে পিতার অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেমন, সন্তানের বংশ পরিচয় পিতার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। আবার, মাতার অধিকারের মধ্যে রয়েছে সন্তানের প্রতিপালন ও স্নেহের অধিকার। ইসলামে পিতা ও মাতা উভয়ের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁদের অধিকারগুলোও সমানভাবে মূল্যবান। এ বিষয়ে আরও জানতে, আপনি ইসলামিক স্কলারদের মতামত জানতে পারেন।
প্রশ্ন ২: পিতা মাতা অমুসলিম হলে তাদের সাথে কেমন আচরণ করা উচিত?
পিতা-মাতা অমুসলিম হলেও তাঁদের সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং তাঁদের প্রতি সম্মান দেখানো সন্তানের কর্তব্য। ইসলামে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতিও সদাচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই, অমুসলিম পিতা-মাতার প্রতিও সন্তানের দায়িত্ব হলো তাঁদের সেবা করা, তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করা এবং তাঁদের সাথে দয়া ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করা। তবে, তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসে প্রভাবিত হওয়া বা তাঁদের ধর্ম অনুসরণ করা সন্তানের জন্য জায়েজ নয়।
প্রশ্ন ৩: পিতা মাতা যদি খারাপ কাজ করতে বলেন, তাহলে কি করা উচিত?
পিতা-মাতা যদি কোনো খারাপ কাজ করতে বলেন, যা ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী, তাহলে সেই কাজে তাঁদের আনুগত্য করা যাবে না। তবে, তাঁদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা বা তাঁদের মনে কষ্ট দেওয়াও উচিত নয়। এক্ষেত্রে, সন্তানের উচিত বিনয়ের সাথে তাঁদের বুঝিয়ে বলা যে কাজটি শরীয়তসম্মত নয় এবং তা করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন ৪: ইসলামে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত কেন বলা হয়েছে?
ইসলামে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত বলার কারণ হলো মায়ের ত্যাগ, ভালোবাসা ও সন্তানের জন্য তাঁর অসীম কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা। একজন মা গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তানকে বড় করা পর্যন্ত যে ত্যাগ স্বীকার করেন, তার প্রতিদান দেওয়া সম্ভব নয়। মায়ের দোয়া ও সন্তুষ্টি সন্তানের জন্য আল্লাহর রহমতস্বরূপ। তাই, মায়ের প্রতি সম্মান ও আনুগত্যের মাধ্যমে সন্তানের বেহেশত লাভ করা সহজ হয়। মায়ের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এভাবে বলা হয়েছে। গর্ভাবস্থায় মায়ের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে d-rise 40000 কেন খাচ্ছেন সে বিষয়ে জেনে নিতে পারেন।
প্রশ্ন ৫: পিতা মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য কি করা উচিত?
পিতা মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য দোয়া করা, তাদের নামে দান করা, তাদের বন্ধুদের সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং তাদের রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করা সন্তানের কর্তব্য। এছাড়া, তাদের অসcomplete কাজগুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা করা উচিত। এই কাজগুলো তাদের আত্মার শান্তি ও মাগফেরাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করে তাদের জন্য দোয়া করুন।
পিতা মাতার অধিকার রক্ষায় আমাদের করণীয়
পিতা মাতার অধিকার রক্ষায় আমাদের কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হলো:
- নিয়মিত তাদের খোঁজখবর রাখা: পিতা-মাতা দূরে থাকলে নিয়মিত তাদের সাথে ফোনে কথা বলুন বা দেখা করতে যান। তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার খোঁজখবর নিন এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করুন।
- তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা: পিতা-মাতা যখন কোনো কথা বলেন, তখন মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিন। তাদের অভিজ্ঞতার কথা থেকে শিক্ষা নিন এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন।
- তাদের সাথে সময় কাটানো: পিতা-মাতার সাথে সময় কাটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাথে গল্প করুন, তাদের পছন্দের খাবার তৈরি করে খাওয়ান এবং তাদের সাথে ঘুরতে যান। এতে তাদের মন ভালো থাকবে এবং তারা নিঃসঙ্গ বোধ করবেন না।
- তাদের সম্মান করা: পিতা-মাতার সামনে উঁচু স্বরে কথা বলবেন না এবং তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না। তাদের সম্মান করুন এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
- তাদের জন্য দোয়া করা: পিতা-মাতার জন্য সবসময় দোয়া করুন। তাদের জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত কামনা করুন।
পিতা মাতার প্রতি সদাচরণের উদাহরণ
ইসলামের ইতিহাসে পিতা মাতার প্রতি সদাচরণের অনেক উদাহরণ রয়েছে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা হলো:
- হযরত ইব্রাহিম (আঃ): হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর পিতার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যদিও তাঁর পিতা ছিলেন একজন মূর্তি পূজারী, তবুও তিনি তাঁর সাথে সবসময় নম্রভাবে কথা বলতেন এবং তাঁর প্রতি সম্মান দেখাতেন।
- হযরত ঈসা (আঃ): হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর মায়ের প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। তিনি মায়ের সেবা করতেন এবং মায়ের কথা মেনে চলতেন।
- সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ): সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) তাঁদের পিতা-মাতার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁরা তাঁদের পিতা-মাতার সেবা করতেন এবং তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করতেন।
এই উদাহরণগুলো থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে পিতা মাতার প্রতি সদাচরণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব।
বিষয় | পিতার অধিকার | মাতার অধিকার |
---|---|---|
বংশ পরিচয় | পিতার মাধ্যমে নির্ধারিত | সন্তানের প্রতিপালন ও স্নেহ |
আর্থিক দায়িত্ব | পরিবারের ভরণপোষণ | সন্তানকে মমতা দেওয়া |
সম্মান | পিতার সম্মান জরুরি | মায়ের সম্মান জরুরি |
আনুগত্য | ভালো কাজে পিতার আনুগত্য | সন্তানের কল্যাণে মায়ের আনুগত্য |
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন এবং তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার মাধ্যমে আমরা একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে পারি।
উপসংহার
ইসলামে পিতা মাতার অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের উচিত তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, তাঁদের সেবা করা এবং তাঁদের জন্য দোয়া করা। পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করতে পারি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে পিতা মাতার অধিকার সম্পর্কে জানার এবং তা যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
পিতা-মাতার প্রতি আপনার ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে আপনার জীবনকে আরও সুন্দর ও অর্থবহ করে তুলুন। তাদের জন্য বেশি বেশি দোয়া ও আমল করুন।